শেখ হাসিনা সরকারের ভয়াবহ পতনে প্রায় দেড় যুগ পর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। অথচ কিছুদিন আগেও রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশায় ভুগছিলেন তারা। জাতীয় নির্বাচনের আগে আন্দোলন করতে গিয়ে দলটির বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীকে কারাগারে যেতে হয়েছিল। গত দু-তিন মাসে তাদের বড় অংশই জামিনে মুক্ত হন। তবে কিছুদিনের মধ্যেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘিরে ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হলে আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হন তারা। অনেকে আরেক দফা গ্রেপ্তার হয়ে জেলে যান। রিমান্ডে চরম নির্যাতনের শিকার হন কেউ কেউ। তবে শিক্ষার্থীদের ব্যাপক বিক্ষোভে এবার সরকারের পতনে আশাবাদী ছিলেন তারা। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। তার পতনের মধ্য দিয়ে বিএনপিতে নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়েছে। এরই মধ্যে মুক্তি পেয়েছেন দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। দল পরিচালনায় দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান। সব মিলিয়ে হতাশা কাটিয়ে চাঙ্গা হয়ে উঠেছেন সারা দেশের নেতাকর্মীরা। তাদের পদভারে মুখর নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়। এতদিন যাদের দেখা যায়নি, এখন তারাও ভিড় করছেন সেখানে। ঢাকায় কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্ধ থাকা দলীয় কার্যালয়গুলো খোলা হয়েছে। নেতাকর্মীরা নির্বিঘ্নে চলাফেরা করছেন।
গত বুধবার ঢাকার নয়াপল্টনে কোনো ধরনের শর্ত ছাড়াই বাধাহীন সমাবেশ করেছে বিএনপি। যেখানে বক্তব্য দেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ শীর্ষ নেতারা। দীর্ঘদিন পর দলের শীর্ষ দুই নেতার বক্তব্য শুনতে পেরে নেতাকর্মীরা আবেগাপ্লুত।
ওই সমাবেশে আত্মগোপনে থাকা নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে এসে অংশ নিয়ে উল্লাস করেন। নেতাকর্মীদের উচ্ছ্বসিত স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে গোটা এলাকা। তাদের চোখে-মুখে ছিল স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্ত বাতাসে বুক ভরে শ্বাস নেওয়ার স্বাদ। তারা বলছেন, বহু বছর পর মুক্ত পরিবেশে স্বাধীনভাবে নিঃশ্বাস নেওয়ার আনন্দ ভাষায় প্রকাশের মতো নয়। কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা আরও চাঙ্গা এবং আরও উজ্জীবিত। তবে দীর্ঘদিন পর বিএনপির জন্য মুক্ত পরিবেশ হওয়ায় নানা বঞ্চনা আর দেনা-পাওনার হিসাব মিলাতে গিয়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দল আরও বিস্তার লাভ করতে পারে বলে নেতাকর্মীরা আশঙ্কা করছেন।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘আমরা এতদিন ছিলাম শৃঙ্খলাবদ্ধ। ফ্যাসিস্ট ও স্বৈরাচার শেখ হাসিনার নির্যাতন-নিপীড়নে দেশের মানুষ বিশেষ করে বিএনপি ও বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা ছিলেন অতিষ্ঠ। এখন স্বৈরাচার হাসিনার পতনের পর মুক্ত পরিবেশে স্বাধীনভাবে বুক ভরে শ্বাস নিতে পারছি। এর চেয়ে আর আনন্দ কী হতে পারে? তিনি বলেন, গণতন্ত্রের শক্তি হলো মানবাধিকার, যা এতদিন শেখ হাসিনা কেড়ে নিয়েছিলেন। এখন দেশের মানুষ মুক্ত। একটি বাধাহীন পরিবেশে বিএনপি সাংগঠনিকভাবে আরও শক্তিশালী হবে। উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সুন্দর নেতৃত্ব তৈরি হবে।’
২০০৬ সালে ক্ষমতা ছাড়ার পর বিএনপির ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন ও ক্র্যাকডাউন শুরু হয়। নির্যাতন এড়াতে দলটির অসংখ্য নেতাকর্মী ছিলেন ফেরারি জীবনে, এমনকি অনেকেই বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। এখন শেখ হাসিনা ও তার সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয়বার স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশে তারা ভয়হীন জীবনে ফিরলেন বলে মনে করছেন। আত্মগোপনে থাকা বিএনপির অসংখ্য নেতাকর্মী রাজধানীতে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কেউ কেউ গ্রামের বাড়িতে গিয়ে মা-বাবা কিংবা স্বজনের সঙ্গে স্বাধীনতার আনন্দ ভাগাভাগি করছেন। অনেকেই বন্ধ থাকা মোবাইলও চালু করেছেন।
ধরনা দিতে হতো দলটিকে। কিন্তু সেদিন নির্বিঘ্নে সমাবেশ করেছে বিএনপি। বহুদিন পর এমন সমাবেশ করতে পারায় বিএনপি নেতাকর্মীদের মাঝে খুশির শেষ নেই। গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রায় ছয় মাস পরে সমাবেশে অংশ নিতে পেরে উজ্জীবিত বিএনপির নেতাকর্মীরা। এদিন দুপুর থেকেই ব্যানার ও ফেস্টুন নিয়ে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে নয়াপল্টনে জড়ো হতে থাকেন বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। সমাবেশে অংশ নিতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় থেকে ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতাকর্মীরা মিছিল নিয়ে আসেন। এ সময় তারা সরকারবিরোধী বিভিন্ন স্লোগানে সমাবেশস্থল মুখর করে তোলেন।
দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতি সম্পর্কে নরসিংদী জেলা বিএনপির সদস্য রফিকুল আমিন ভূঁইয়া রুহেল বলেন, ‘ছাত্র-জনতার তুমুল বিক্ষোভের মুখে শেখ হাসিনার পলায়ন এবং আওয়ামী লীগ সরকারের ভয়াবহ পরাজয়ে তারা যারপরনাই খুশি। এখন তারা ভয়হীনভাবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন। আবারও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সারা দেশের সাংগঠনিকভাবে চাঙ্গা হবেন।’