শিল্প এলাকায় সমৃদ্ধ গাজীপুরের শ্রীপুর পৌরসভা গঠিত হয়েছে ২০০০সালে। রাজধানীর কাছের এই নগরে নানা উন্নয়ণ সুবিধার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নাগরিকদের কাছ থেকে উচ্চ হারে কর আদায় করলেও লুটপাটের কারণে সিকি ভাগ উন্নয়ণ হয়নি এখনও।
পৌরবাসীর অভিযোগ দীর্ঘ দুই যুগ ধরে নগরের দায়িত্বে ছিলেন গাজীপুর জেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আনিছুর রহমান। একচ্ছত্র আধিপত্য, অনিয়ম দুর্নীতি করে আনিছ ও তার কর্মকর্তা কর্মচারীরা লুটে নিয়েছেন পৌরসভার কোটি কোটি টাকা। পৌরসভাকে পরিণত করেছিলেন নিজের পৈত্রিক সম্পত্তি হিসেবে।
পৌরসভার তিনটি গাড়ী ব্যবহারের পাশাপাশি নিজের বাসার বাজার, বিদ্যুৎবিল, নিত্যদিনের খরচ সহ যাবতীয় কিছৃ ব্যায় হতো পৌর তহবিল থেকে। এমনকি ধুমপানের টাকাও নিতো পৌরফান্ড থেকে। যা দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা পরে বিভিন্ন বিল ভাউচারের মাধ্যমে সমন্বয় করতো। পৌরসভার প্রতিঅর্থবছরে নিজস্ব আয় ৫০কোটি টাকার উপর। অথচ উন্নয়ণ না করেই এ টাকা হাতিয়ে নেয়া হতো বিভিন্ন কৌশলে। ফলে উন্নয়ণবঞ্চনার শিকার হয়েছেন পৌরবাসী।
গত ৫ আগষ্টের পর গা ঢাকা দেন আনিছ। যদিও পৌরসভার প্রতিটি স্থানে স্থানে রয়ে গেছে তার দুর্নীতির চিত্র, আর পৌরবাসীর মুখে মুখে উন্নয়ণ বঞ্চনার গীত ভেসে বেড়াচ্ছে।
আনিছুর রহমান সর্বশেষ দুই মেয়াদের ১০বছর ভোট জালিয়াতি করে নৌকা প্রতিক নিয়ে জয়লাভ করেন। এর পর থেকেই হয়ে উঠেন বেপরোয়া। তার কথায় ছিল আইন। সরকারী কোন নিয়ম কানুনের তোয়াক্কা করেননি কখনও। তার ইচ্ছেমতো পরিচালনা হতো সব। তবে তার সহযোগী হিসেবে কাগজপত্র তৈরী ও বিল ভাউচার তৈরী করে দিতো দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। তাকে সহায়তা করার সুযোগে পৌরসভার পিয়ন থেকে কর্মকর্তা পর্যন্ত সবাই আজ কোটিপতির তালিকায়। মেয়র পলাতক থাকায় অনেক কর্মকর্তা ও কর্মচারী গা বাঁচাতে বিএনপির নেতাকর্মীদের পেছনে ধর্নাও দিচ্ছেন এখন।
হাটবাজারের টাকা আত্নসাত ও পৌরসভায় কর্মচারী নিয়োগে দূনীতির আশ্রয় নেয়ায় ২০১০ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত দুদক পাচটি মামলা করেন আনিছ ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে। চার্জশীটের পর মামলার বিচারকাজ শুরু হওয়ার পর হঠাৎ করেই পরে আর মামলার কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। পরে জানা যায় সাবেক মন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হক প্রভাব দেখিয়ে আনিছকে মামলা থেকে রেহাই দেয়া হয় গোপনে। মামলাগুলোর মধ্যে তিনটি কর্মচারী নিয়োগে দুর্নীতি ও অপর দুটি মামলায় দুটি বাজার ইজারার ভ্যাট, আয়কর ও জামানত বাবদ রাজস্ব আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছিল।
২০০৯ সনে জিপ চালক পদে হেলাল উদ্দিন, ট্রাক (গার্বেজ) চালক পদে মাঈন উদ্দিন, রোড রোলার চালক পদে নজরুল ইসলামকে নিয়োগ দেওয়া হয়। দুদকের অনুসন্ধানে এদের প্রত্যেকের ড্রাইভিং লাইসেন্স ভুয়া হিসেবে প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছিল। পৌরসভা কর্তৃপক্ষ কোনোরকম যাচাই বাছাই না করেই দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে তাদের নিয়োগ প্রদান করেছেন বলে পৌর কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল। যদিও মেয়রের বদান্যতায় এখনও বহাল তবিয়তে আছেন তারা।
করোনার সময় গোপনে নিয়োগ দেয়া হয় ১০জনকে:
সারা দেশ করোনায় আক্রান্ত, ভয় আতঙ্ক চারপাশে, লকডাউন চলমান। ২০২০সালে সে সময় গোপনীয়তার সাথে ৮টি পদে নিজস্ব ১০জনকে নিয়োগ দেন মেয়র আনিছ। অভিযোগ আছে দেড় কোটি টাকার বানিজ্য করেছেন তখন। সে নিয়োগে একই পরিবারের কয়েকজনকে নিয়োগ দেয়া হয়। নিয়োগ পরীক্ষা সম্পর্কে কেউ অবগত না থাকার পরও সে নিয়োগের ঘোর এখনও কাটেনি। স্থানীয় সরকার মন্ত্রনালয় থেকে তদন্ত করার জন্য বলা হলেও তদন্ত রিপোর্ট মেলেনি আদৌ। ২০২৩ সালের ৯ফেব্রুয়ারী স্থানীয় সরকার বিভাগের উপসচিব আব্দুর রহমান স্বাক্ষরিত এক পত্রে দ্রুত অবৈধ নিয়োগের তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য গাজীপুর স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালককে নির্দেশ দিলেও পরে মেয়রের প্রভাবের কারণে সে নিয়োগের তদন্ত হয়নি এখনো।
মেয়রের গাড়ী বিলাশ:
মেয়র আনিছের ব্যবহারের জন্য পৌরসভার তহবিল থেকে প্রায় ৪৫লাখ টাকা ব্যয়ে একটি পাজেরো জিপ কেনা হয় ২০১০সালে। সে সচল গাড়ীটি রেখে ২০১৫সালে ফের পৌর তহবিল থেকে প্রায় ৯০লাখ টাকা ব্যায়ে আরো একটি পাজেরো স্পোর্টস কার কেনা হয়। দুটি গাড়ীই মেয়র তার ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করতেন। গাড়ীর জ্বালানী সহ মেরামত সবই হতো পৌর তহবিল থেকে। এছাড়াও ইউজিএপ-২ প্রকল্প থেকেও আরো একটি হাইলাক্স জিপ গাড়ীও দেয়া হয়, যা ব্যবহার করেন পৌরসভার সচিব রফিকুল হাসান।
পৌর কার্যালয়েও বিলাশ: প্রথম শ্রেণীর এ পৌরসভার নিজস্ব কোন কার্যালয় ছিল না। ২০২১ সালে ৪ কোটি ৯৫ লাখ ব্যায়ে বিএমডিএফের অর্থায়নে ঋণের টাকায় মাল্টিপারপাস একটি বিল্ডিং তৈরী করা হয়। নির্মাণের শর্ত ছিল এটি হবে আয়বর্ধনমূলক বিল্ডিং। অথচ নির্মাণের পর মূল নকশা আড়াল করে এটিকে তৈরী করা হয় পৌর কার্যালয় হিসেবে। পৌর তহবিল থেকে কোটি টাকা খরচ করে ইন্টেরিয়ার ডিজাইন ও প্রতিটি কক্ষে বসানো হয় শীতাতপনিয়ন্ত্রিত যন্ত্র। কার্যালয়ের বিলাসিতা সাধারন মানুষকেও হতবিহবল করেছে।
কোটেশনের মাধ্যমে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে লাখ লাখ টাকা:
পৌরসভা প্রতিষ্ঠার পর থেকেই নানা উপায়ে পৌর তহবিল থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। এর অন্যতম একটি প্রক্রিয়া ছিল কেটেশন। কাজ না করেও পৌরসচিব ও প্রকৌশলীদের যোগসাজসে টেন্ডারবহির্ভুত এ প্রক্রিয়া টাকা হাতিয়ে নেয়া ছিল নিত্তদিনের ঘটনা। প্রতিঅর্থবছরে স্টেশনারী মালামাল বাবদ বিল ভাউচার দেখিয়ে সচিবও হাতিয়ে নিতো টাকা পয়সা। মেয়র সকল খাত থেকেই পেতো তার নির্দ্দিষ্ট কমিশন। এছাড়াও নিজের লোকদের পৌর তহবিল থেক অনুদান, টিআর, কাবিখার কাজেও ছিল চরম অনিয়ম। পৌরসভার জঙ্গল পরিস্কার ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার নামেও কোটি কোটি টাকার বিল হাতিয়ে নেয়া হয়েছে পৌরসভার তহবিল থেকে।
সংরক্ষিত বনের ভেতর পৌরসভার প্রকল্প:
মেয়র আনিছ নিজে লাভবান হতে সংরক্ষিত বনের ভেতর ৫৫লাখ টাকা ব্যায় দেখিয়ে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার প্লান্ট তৈরী করতে জমি কিনেছিলেন। এ জমির বর্তমান সর্বোচ্চ বাজার দর ১৫লাখ টাকা। রাস্তাবিহীন এ জমিতে পরে বনবিভাগ কাজ বন্ধ করে দেয়। এমনকি মেযরের নামে বনবিভাগ মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নেয়। তবে ক্ষমতার প্রভাব দেখিয়ে তিনি মামলা থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করিয়ে নেন। এ প্রকল্পেরর পুরোটাই এখন অন্ধকারে।
পৌর তহবিল থেকে আত্নসাত ১ কোটি ৬০ লাখ ৪০ হাজার টাকার হদিস নেই:
২০১৯-২০২০ অর্থবছরে মেয়রের যোগসাজসে রাজস্ব আদায়ের টাকা পৌর তহবিলে জমা না দিয়ে ১ কোটি ৬০ লাখ ৪০ হাজার টাকা আত্নসাতের ঘটনা ঘটে। বিষয়টি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করলেও প্রকাশ হয়ে যায়। পরে বাধ্য হয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করে মেয়র। সে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী কর আদায়কারী মো. শফিউল আলম রায়হান এক কোটি ৬লাখ ৪হাজার, সহকারী কর আদায়কারী ফাহিমা সানজিদ ৫২ লাখ ও জান্নাতুল ফেরদৌস দুই লাখ ৩৬ হাজার টাকা আত্নসাৎ করেছিলেন বলে উল্লেখ করা হয়। এ ঘটনায় বিভাগীয় মামলার সুপারিশ করেছিল তৎকালীন তদন্ত কমিটি। শুধু শফিউল রায়হান বরখাস্ত হলেও অপর দুই সহযোগী ফাহিমা ও জান্নাতুল ফেরদৌস এখনও বহাল তবিয়তে।
কম যাচ্ছেন না পৌর নির্বাহী রফিকুল হাসানও:
প্রথম শ্রেণীর এ পৌরসভায় প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা থাকার কথা থাকলেও মেয়রের অনিচ্ছায় প্রধান নির্বাহীরা যোগদান করতে পারেননি। ২০২২সালে সুমিত সাহা যোগদান করেন। এসময় এক বছরের মধ্যে পৌরসভার সকল বকেয়া পরিশোধ করে প্রায় ৭কোটি টাকার ফান্ড গঠন করা হয়। সে টাকার লোভে পরে তাকে কিছুদিনের মধ্যেই বদলী হতে বাধ্য করা হয়। সে চলে যাওয়ার একদিনের মধ্যেই কয়েকশো চেকের মাধ্যমে সে টাকা হাতিয়ে নেন সচিব ও সহযোগীরা। অভিযোগ আছে পৌর নির্বাহী রফিকুল হাসান নিজের কর্তৃত্ব কমে যাওয়ার আশঙ্কায় কয়েকদিনের মধ্যে আরো কয়েকজন প্রধান নির্বাহীদের যোগদানের আদেশ হলেও পৌরসভায যোগদান করতে দেননি। মেয়র আনিছের সহযোগী হিসেবে পৌরসভার বিভিন্ন ভুয়া প্রকল্প তৈরী করে তিনিও হাতিয়ে নিয়েছেন কাড়ি কাড়ি টাকা। গোপনে আরেকটি নিয়োগেরও ছাড়পত্র এনে প্রচেষ্টা চালিয়েছেন তিনি। পরে স্থানীয়দের মধ্যে তা ছড়িয়ে পড়ায় তিনি আর সফল হতে পারেননি। ঠিকাদারদের কাছ থেকে তার কমিশন আদায় করা এখন শ্রীপুরে ওপেন সিক্রেট। তিনি নিজেকে স্থানীয় সরকারের এক অতিরিক্ত সচিবের আত্নীয় পরিচয় দিয়ে থাকেন।
এ বিষয়ে শ্রীপুর নাগরিক কমিটির সদস্য শফি কামাল বলেন, আনিছুর রহমকন দলীয় প্রভাবে ছিল একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী। সে নিজে দুর্নীতি করেছেন, তার সহযোগীদের দুর্নীতিতে সহযোগিতা করেছেন। নাগরিকদের কোটি কোটি টাকা আত্নসাত করে পৌরসভাকে তলাবিহীন ঝুড়িতে রুপান্তর করেছেন। দীর্ঘদিন তিনি স্বজনপ্রীতি, দলীয়কর্মীদের সহযোগিতা সহ নিজে নামে বেনামে সম্পদ গড়েছেন। সরকারের উচিত এখন অতীতের কর্মতান্ডগুলো খতিয়ে দেখা।
শ্রীপুর পৌর নির্বাহী রফিকুল হাসান তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। পৌরসভার টাকা আত্নসাতের বিষয়ে তিনি বলেন, দুইজন টাকা ফেরত দেয়ায় তারা চাকুরী করেছেন,আর একজনকে চূড়ান্ত বরখাস্ত করা হয়েছে। বিভাগীয় মামলার বিষয়ে তিনি বলেন এগুলো ডিসমিস হয়েছে।
এ বিষয়ে শ্রীপুর পৌর প্রশাসক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ব্যারিষ্টার সজিব আহমেদ সার্বিক বিষয়ে বলেন, বেশ কিছুদিন হলো তিনি দায়িত্ব নিয়েছেন, সবগুলোই খোঁজ নিয়ে দেখবেন। তবে এখন রুটিন কাজগুলো সচ্ছতার সাথে করার চেষ্টা হচ্ছে, যেন নাগরিকরা তাদের সুবিদাগুলো দ্রুত পেতে পারে।