https://p.dw.com/p/4mpPq
খেলাধুলাবাংলাদেশ
কলসিন্দুর, রাঙ্গাটুঙ্গী থেকে ‘হিমালয়ের’ কাছাকাছি
বদিউজ্জামান মিলন
09.11.2024৯ নভেম্বর ২০২৪
চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ তখন নেপাল থেকে ঢাকায় ফিরছে। বিমানে অধিনায়ক সাবিনা খাতুনের পাশের সিটে মিডফিল্ডার মাতসুশিমা সুমাইয়া।
https://p.dw.com/p/4mpPq
সাফ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ দলের সদস্যরা দেশে ফেরার সময় বিমান থেকে হিমালয় পর্বতমালার ছবি তুলছেন
সাফ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ দলের সদস্যরা দেশে ফেরার সময় বিমান থেকে হিমালয় পর্বতমালার ছবি তুলছেনছবি: DW
বিজ্ঞাপন
জানালায় উঁকি দিয়ে সাবিনাকে বলছিলেন, “এখান থেকে কি হিমালয় দেখতে পারবো?”
উত্তরে সাবিনা বলেন, “তোরা নিজেরাই তো একেক জন হিমালয়। তোদের আবার হিমালয় দেখার কী দরকার?”
কথাটা ভুল বলেননি সাবিনা। ৩০ অক্টোবর নেপালে নারী সাফের ফাইনালে স্বাগতিকদের হারিয়ে টানা দ্বিতীয়বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ। কাঠমান্ডুর দশরথ স্টেডিয়ামের উপচে পড়া গ্যালারির ১৫ হাজার উন্মাতাল দর্শককে স্তব্ধ করে সাবিনা, কৃষ্ণারা আরেকবার সাফের ট্রফি নিয়ে এসেছেন বাংলাদেশে।
অথচ মাঠে ও মাঠের বাইরে এই মেয়েরা সারাক্ষণ লড়াই করে চলেছে। লড়াই করতে করতেই একেকটি ধাপ পেরিয়েছে। এভাবেই একেকবার উঠেছে হিমালয়সম উচ্চতায়।
বাংলাদেশের এই নারী ফুটবল দল ২০২২ সালের সাফে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরও নানামুখী সংকটে ভুগেছে। সাফ চ্যাম্পিয়নদের মানবেতর জীবন কাটাতে হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এক কক্ষে গাদাগাদি করে ৮ জন থাকেন তারা। বাথরুম একটি, পান না পুষ্টিকর খাবার!
বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)-র মতো ব্যস্ত দাপ্তরিক ভবনের চতুর্থ তলার ১১টি কক্ষ বরাদ্দ ৭০ নারী ফুটবলারের জন্য। যে ভবনে নেই লিফট। দৈনিক একাধিকবার ট্রেনিং, জিম সেরে সেই ভবনের সিঁড়ি বেয়ে ক্লান্ত মেয়েদের পৌঁছাতে হয় কক্ষে। ফুটবল ভবনে নানা ধরনের মানুষের নিত্য আসা-যাওয়া। তাই সিঁড়ি বেয়ে ওপরের তলায় উঠতে গিয়ে মেয়েদের পড়তে হয় অস্বস্তিতে। কক্ষে পৌঁছেও শান্তি নেই। একেকটি কক্ষে ছয় থেকে আটজনকে থাকতে হয় গাদাগাদি করে। এভাবেই হাজারো প্রতিকূলতা সয়ে দেশকে এনে দেন একের পর এক সাফল্য।
এসব অভিযোগ অস্বীকার করেননি বাফুফের গত কার্যনির্বাহী কমিটির নারী ফুটবল উইংয়ের চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার। নতুন নির্বাচিত কমিটির এই সদস্য বলেন,”মেয়েদের থাকার জায়গার বিষয়ে বলবো, আমাদের সামর্থ্যের মধ্যে আছে ৪ তলার ডরমেটরি। এর বাইরে জায়গা নেই। এজন্য সরকারকে সহযোগিতা করতে হবে। সরকার যদি সহযোগিতা করে তাহলে অবশ্যই সেখানে মেয়েরা আরাম করে থাকবে। এখন যেহেতু এখানে একোমোডেশন ছোট, স্বাভাবিক কারণেই একটা রুমের মধ্যে ৪-৫ জন করে থাকতে হয়। এর বেশি তো আমরা কিছু করতে পারবো না। সরকার চাইলে বিকেএসপির মতো একটা ট্রেনিং সেন্টার আমাদের করে দিতে পারে।”
সবচেয়ে বড় কথা সাবিনা, সানজিদাদের মূল যে কাজ ফুটবল খেলা, সেটাই তো হয়নি। বাফুফে তাদের পর্যাপ্ত ম্যাচ খেলার সুযোগ করে দেয়নি। এমনকি ঘরোয়া ফুটবলে যে নারীদের লিগ আয়োজন করা নামকা ওয়াস্তে। দেশের ফুটবলের অন্যতম বড় ক্লাব বসুন্ধরা কিংস সর্বশেষ নারী লিগে দল গড়েনি বাফুফের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে। এতে আর্থিকভাবে তো বটেই, পারফরম্যান্সের দিক দিয়েও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সাবিনা, মারিয়ারা।
কোনোরকমে শেষ মুহূর্তে জাতীয় দলের ফুটবলাররা নাসরিন স্পোর্টিং ক্লাবে যোগ দিলেও চাহিদামতো পারিশ্রমিক পাননি। এমনকি বসুন্ধরা কিংসের মতো বড় ক্লাব না থাকায় লিগও হয়েছে একপেশে। কোনোা প্রতিদ্বন্দ্বিতাই ছিল না নারী ফুটবল লিগে।
২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথমবার দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট মাথায় পরে বাংলাদেশ। এরপর গত দুই বছরে মাত্র ৮টা ফিফা ফ্রেন্ডলি ম্যাচ খেলেন সাবিনারা! ২০২৩ সালের জুলাইয়ে নেপালের সঙ্গে খেলে দুটি প্রীতি ম্যাচ। এরপর একই বছর ডিসেম্বরে সিঙ্গাপুরের সঙ্গে আরও দুটি ফিফা ফ্রেন্ডলি ম্যাচ খেলেছে বাংলাদেশ। ২০২৪ সালে মে ও জুনে দুটি প্রীতি ম্যাচ খেলেছে চাইনিজ তাইপের সঙ্গে । সর্বশেষ এ বছর জুলাইয়ে ভুটানের সঙ্গে খেলে বাকি দুটি প্রীতি ম্যাচ।
এর বাইরে গত বছর সেপ্টেম্বরে এশিয়ান গেমসের ফুটবলে ভিয়েতনাম, জাপান ও নেপালের বিপক্ষে ৩টি ম্যাচ খেলে বাংলাদেশ।
প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ফুটবল ম্যাচ নিয়মিত না খেলেও ক্যাম্প আর অনুশীলনের পর এভাবে চ্যাম্পিয়ন হওয়াটাকে অবিশ্বাস্য ঘটনা বলছেন মাহফুজা আক্তার, “আমাদের কোনো মাঠ নেই আপনারা খুব ভালো করে জানেন। আমরা অনুশীলন করতে পারি না, খেলবো কোথায়? এ অবস্থায় বাংলাদেশে যে ফুটবল আছে, বাংলাদেশ যে দক্ষিণ এশিয়ায় চ্যাম্পিয়ন-এটা তো আমি বলবো অলৌকিক। এটা হওয়ার কথা নয়।”
বাংলাদেশে কি আদৌ নারী ফুটবল চর্চা হওয়ার কথা ছিল? বাংলাদেশের মেয়েদের ফুটবল-বিপ্লব এক দিনে আসেনি। ২০০৫ সালের এপ্রিলে প্রথম দক্ষিণ কোরিয়ায় এএফসি অনূর্ধ্ব-১৭ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে খেলতে যায় বাংলাদেশ, যেটা ছিল মেয়েদের ফুটবলে ফিফা স্বীকৃত কোনো প্রথম আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা।
মৌলবাদীদের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে ২০০৩ সালে দেশে গোড়াপত্তন হয় মেয়েদের ফুটবলের। এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশন (এএফসি)-র প্রথম আমন্ত্রণ আসে দুই বছর পর ২০০৫ সালে।
মেয়েদের বর্তমান দলের তিন আদিবাসী কন্যা- মনিকা চাকমা, রুপনা চাকমা, ঋতুপর্ণা চাকমারা দুর্দান্ত পারফর্মার। তবে ২০০৫ সালে ১১ জন আদিবাসী মেয়েকে নিয়ে ২৩ সদস্যের দল গড়ে দক্ষিণ কোরিয়ায় পাঠাতে হয়েছিল।
৩ মাসের অনুশীলনে কোরিয়া যাওয়ার আগে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ৪টি প্রস্তুতি ম্যাচ খেলার সুযোগ পায় দলটি। কিন্তু কোরিয়ার মাঠে তাদের মুখোমুখি হতে হয় কঠিন বাস্তবতার। প্রথম ম্যাচে গুয়ামের কাছে ১-০ গোলে হার। পরের ম্য্যাচে জাপান গুণে গুণে দিয়েছিল ২৪ গোল। গ্রুপের শেষ ম্যাচে হংকংয়ের সঙ্গে লড়াই করলেও হেরেছিল ২-৩ ব্যবধানে।
ওই দলের ম্যানেজার ছিলেন বাফুফের তৎকালীন মহিলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক কামরুন নাহার ডানা। জাপানের কাছে বৃষ্টির মতো গোল খাওয়া সেই মেয়েরা এখন প্রতিপক্ষকে গুণে গুণে গোল দেয়। মেয়েদের ফুটবলে সত্যিই দিন বদলে গেছে।
মেয়েদের এমন সাফল্যে গর্বে বুকটা ভরে ওঠে ডানার, “অবশ্যই এই মেয়েদের খেলা দেখলে খুব ভালো লাগে।” শুরুতে কাজটা কত কঠিন ছিল সেটাও বললেন এই নারী সংগঠক, “যখন ফুটবল শুরু করি, তখন ফুটবল ফেডারেশনের সহকর্মী, পুরুষ ফুটবলরারা বলতেন- ডানার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। ওরা কি বলে লাথি মারতে পারবে? আমি জানতাম, ইনশাল্লাহ বাংলাদেশের মেয়েরা পারবে। ২০০৬ সালে উড়িষ্যার দলকে নিয়ে এসেছিলাম কত বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে। খেলা আয়োজন করা হবে চট্টগ্রামে। তখন ফুটবল কমিটির চেয়ারম্যান বাচ্চু ভাই (আমিরুল ইসলাম বাচ্চু) বললেন- তুমি পারবে না। আমি বললাম, পারবো। চট্টগ্রাম ডিভিশনের পুলিশ কমিশনার আমার বড় ভাই। বাচ্চু ভাই , মালু ভাইদের (মনজুর হোসেন মালু , বাফুফের কর্মকর্তা) নিষেধ সত্বেও চট্টগ্রামে রওয়ানা দিই নারী দল নিয়ে। তখন ফুটবল খেলা আয়োজন করতে গিয়ে টেলিফোনে আমাকে হত্যার হুমকিও দিয়েছিল।”
তিনি এরপর যোগ করেন, “মেয়েদের ফুটবলে কোনো টাকা-পয়সা নেই। অথচ ১৯৯৬ সাল থেকে ফিফা টাকা দেয় নারী ফুটবলের জন্য। সেটাও তখন মেয়েদের বাবদ খরচ করতে ভয় পেতেন কর্মকর্তারা। ছেলেদের ফুটবলে খরচ করতেন সেটা। আমি জানার পর বাফুফের নতুন কমিটির প্রথম সভায় বিষয়টা তুলি। বলি, আমার হোস্টেল আছে, জায়গা আছে আপনারা শুধু মিটিংয়ে মেয়েদের ফুটবলটা পাস করেন। আমার টাকাপয়সা নেই। আপনারা আর্থিক সহায়তা দেবেন। আমি সরকারকে সামলে নেবো।”
যদিও নারী ফুটবলের বড় জাগরণটা শুরু হয় ২০১১ সালে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব গোল্ডকাপ ফুটবল দিয়ে। যেখানে ময়মনসিংহের কলসিন্দুর প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে জাতীয় দলে উঠে আসেন মারিয়া মান্দা, তহুরা খাতুন, শিউলি আজিম, শামসুন্নাহার সিনিয়র, সাজেদা খাতুন, শামসুন্নাহার জুনিয়র, সানজিদা আক্তারদের মতো প্রতিভাবান ফুটবলার।
তাদের দেখাদেখি একে একে রংপুরের পালিচড়া গ্রাম, ঠাকুরগাঁওয়ের রাঙ্গাটুঙ্গী, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, মাগুরা থেকে একাধিক মেয়েরা জায়গা করে নিয়েছে জাতীয় দলে।
এসব মেয়েদের জাতীয় দলে উঠে আসার পথটা মোটেও মসৃণ ছিল না। সমাজের কটু কথা সইতে হয়েছে। অনেকে তো পরিবারের সমর্থনও পাননি।
এবারের সাফজয়ী দলের স্ট্রাইকার মোসাম্মৎ সাগরিকার বাবা লিটন মিয়া ঠাকুরগাঁয়ের রাঙ্গাটুঙ্গী গ্রামের চা দোকানদার। নিজের জায়গা জমি নেই। অন্যের জমিতে থাকেন। মেয়ে ফুটবল খেলুক কখনো চাইতেন না। ফুটবল খেললে মেয়ের বিয়ে হবে না। গ্রামের লোক বাজে কথা বলবে। তাই মেয়েকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন। সেই মেয়ে ঢাকায় এসে ফুটবল খেলে জায়গা করে নেন বয়সভিত্তিক ও জাতীয় দলে। ভুটানের বিপক্ষে ফিফা প্রীতি মাচে অভিষেকে হ্যাটট্রিক করেন সাগরিকা। এরপর জাতীয় দলেও সাফে বদলি নেমে দুর্দান্ত খেলেছেন। মেয়ের প্রতি এখন আর রাগ-অভিমান নেই লিটন মিয়ার।
শুধু সাগরিকাই নন। এবারের সাফ জয়ী দলে রাঙ্গাটুঙ্গী থেকে উঠে আসা আরো দুই ফুটবলার আছেন- মিডফিল্ডার স্বপ্না রানী, ডিফেন্ডার কোহাতি কিসকু।
এদের সংগ্রামের গল্পটা শুনুন রাঙ্গাটুঙ্গী ফুটবল একাডেমির কোচ তাজুল ইসলামের মুখে। ২০১৪ সালে তিনি নিজের গ্রামে রাঙ্গাটুঙ্গী ইউনাইটেড ফুটবল একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন। এই একাডেমির ১৪ জন ফুটবলার ২০১৬ থেকে এ পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে বয়সভিত্তিক ও জাতীয় দলে খেলেছে।
তাজুল ইসলাম বলেন, “যখন শুরু করি তখন মেয়েরা ফুটবল খেলবে এটা অবিশ্বাস্য ছিল। সমস্যা হলো মেয়েরা খেলতে রাজি, বাবা-মায়েরাও রাজি। কিন্তু পাড়া পড়শিরা বলত ফুটবল খেললে এই মেয়েদের বিয়ে হবে না। কঠিন চ্যালেঞ্জ ছিল কাজটা।”
কিন্তু সাফল্য পেলে কষ্টের কথা ভুলে যান তাজুল, “আমি জানতাম কাজ শুরু করতে গেলে বাধা আসবে। সব রকমের সমস্যার মুখোমুখি হওয়ার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম। আমাকে কেউ সহযোগিতা করেনি। শুধু জেলা প্রশাসক ও স্থানীয় পুলিশ ও ইউনিয়ন পরিষদ সামাজিক প্রটেকশন, সাপোর্ট দিয়েছে। কোনও আর্থিক সহযোগিতাও পাইনি। তবু সাফল্য পেলে সব কষ্ট দূর হয়ে যায়।”
লক্ষ্য অটুট ছিল বলেই মেয়েরা সাফল্য পাচ্ছে বলে মনে করেন তিনি, “ওদের ভালো বুট, খাবার, ভালো প্রশিক্ষক দিতে পারিনি। শুধু স্বপ্ন দেখিয়েছি। এতেই এতদূর এসেছে ওরা।”