মাহফুজুর রহমান একজন প্রান্তিক মৎস্য চাষি। গত বছর তার একটি পুকুরের ৩৫০ গ্রাম ওজনের ১৪ হাজার মাছ আকস্মিকভাবে মারা যায়। চলতি বছরের শুরুতেও তার আরেকটি পুকুরে প্রায় ২২ লাখ টাকার ১০ টন শিং মাছ মারা যায়। পরীক্ষা করে পানিতে কোনো সমস্যা না পাওয়ায় মাছগুলো মারা যাওয়ার কারণ জানতে পারেননি তিনি। তার পক্ষে এত বড় ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
তবে এ ধরনের অনাকাঙ্খিত ঘটনা থেকে রক্ষা পেতে এবং লাভজনক মাছ চাষে নিজের উদ্ভাবিত এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি ব্যবহার করে সাফল্য পাওয়ার দাবি করেছেন ত্রিশালের ইউএনও জুয়েল আহমেদ। তিনি এটির নাম দিয়েছেন অ্যাকুয়া কালচার ৪.০ প্রযুক্তি। এ পদ্ধতিতে মাছ চাষের জন্য পুকুরের গভীরতা হতে হবে ১৮ ফুট, যেখানে প্রচলিত পদ্ধতিতে পুকুরের গভীরতা ৫-৬ ফুট হয়।
জানা যায়, কৃষিজমি ঠিক রেখে অল্প জমিতে কীভাবে অধিক মাছ চাষ করা যায় এবং কীভাবে মৎস্য চাষিদের লোকসান কমানো যায়, তা নিয়ে বছরখানেক আগে গবেষণা শুরু করেন ইউএনও জুয়েল।
এ জন্য পরীক্ষামূলকভাবে উপজেলার কানিহারী ইউনিয়নে ১৮ ফুট গভীরতার ৫৮ শতাংশের একটি সরকারি পুকুরে নিজের উদ্ভাবিত অ্যাকুয়া কালচার ৪.০ প্রযুক্তিতে মাছ চাষ শুরু করেন। এতে অভূতপূর্ব সফলতা পান তিনি। পরীক্ষামূলক চাষে সফল হওয়ায় এখন প্রশিক্ষণ, অন্য প্রজাতির মাছের জন্য পাইলট প্রকল্প গ্রহণ ও চাষিপর্যায়ে প্রযুক্তি ছড়িয়ে দিতে কাজ করছেন ইউএনও জুয়েল।
গত এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে ওই পুকুরে ৬৫ হাজার পাঙ্গাসের পোনা ছাড়া হয়। তখন প্রতিটি মাছের গড় ওজন ছিল ৫৫ গ্রাম। ছয় মাসে সেগুলোর গড় ওজন দাঁড়িয়েছে সাড়ে ১২শ গ্রামে। অথচ প্রচলিত পদ্ধতিতে ৬৫ হাজার পাঙ্গাসের পোনা মাছ দেড় থেকে দুই কেজি ওজনের করতে হলে সাড়ে ৪ একর জমির প্রয়োজন বলে জানান সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সামসুজ্জামান। কেন না, সাধারণত চাষের পুকুরের গভীরতা থাকে ৫-৬ ফুট। শতাংশে চাষ করা যায় ১৫০ থেকে ২০০টি পাঙ্গাস। তাই অ্যাকুয়া কালচার ৪.০ পদ্ধতি ব্যবহারে মৎস্যচাষিরা উপকৃত হবেন বলে জানান তিনি।
প্রযুক্তি যেভাবে কাজ করে:
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক অ্যাপস পুকুরে অক্সিজেন, পিএইচ, টিডিএস, টেম্পারেচারের মাত্রা কত এবং তার ভিত্তিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এয়ারেটর যন্ত্র অন বা অফ করে। অ্যামোনিয়ার পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে তা জানানোর সঙ্গে সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ড্রেনেজ পাম্প ও এয়ারেটর যন্ত্র অন করে পুকুরের তলদেশের বর্জ্য পদার্থ কমাতে কাজ করে। মাছের প্রজাতি অনুসারে কখন কী পরিমাণ খাবার প্রয়োজন, সেটা জানা যায় এবং সে অনুযায়ী স্বয়ংক্রিয় ফিডার মেশিন খাবার দেওয়ার ব্যবস্থা করে। এসব কাজে মানুষের কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ প্রয়োজন পড়ে না। রেইন সেন্সর ও ওয়েদার ফোরকাস্টিং টুলস ব্যবহারের ফলে চাষি বৃষ্টির সম্ভাবনা ও তাপমাত্র সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য আগে থেকেই জানতে পারেন। একটি চাষ চক্রে খামারে কী পরিমাণ বিদ্যুৎ ও খাদ্য ব্যয় হয়েছে, তার নির্ভুল হিসাব এই অ্যাপসের মাধ্যমে পাওয়া যায়।
এসব বিষয় সাধারণ চাষিদের অজানা থাকার কারণে অনেককেই লোকসান গুনতে হতো।
সরেজমিন দেখা যায়, ওই পুকুরপাড়ের চারপাশে রাখা আছে খাবার ছিঁটানোর চারটি যন্ত্র। অক্সিজেন সাপ্লাই বৃদ্ধির জন্য পানির নিচে ও উপরে স্থাপন করা হয়েছে আট ধরনের আটটি এয়ারেটর যন্ত্র। প্রয়োজন অনুসারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হচ্ছে যন্ত্রগুলো। সংশ্লিষ্টরা জানান, এক একর পুকুরে এই প্রযুক্তি অনুসরণ করে মাছ চাষ করলে সেন্সরসহ অন্যান্য মেশিনারিজ সামগ্রী ক্রয়ে খরচ হবে সর্বোচ্চ ৩-৫ লাখ টাকা।
এই পাইলট প্রকল্পের কারিগরি পরামর্শক রনি সাহা বলেন, অত্যাধুনিক অ্যাকুয়া কালচার ৪.০ প্রযুক্তি ব্যবহারে ১৮ থেকে ২০ ফুট গভীরতার পুকুরে শতাংশে ১২শ পাঙ্গাশ মাছ পালন করা যায়, যা সাধারণের তুলনায় পাঁচগুণ বেশি। অল্প জমিতে বেশি মাছ চাষ করার পাশাপাশি খাবার ও শ্রমের সাশ্রয় হয় এবং ফলন পাওয়া যায় তুলনামূলক কম সময়ে। পানির গুণগত মান নিয়ন্ত্রিত থাকায় এই পদ্ধতিতে চাষকৃত মাছ সুস্বাদু হয়।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার জুয়েল আহমেদ জানান, ত্রিশালের অধিকাংশ মানুষ মৎস্য চাষের সঙ্গে জড়িত। কৃষিজমি রক্ষা করে বিদ্যমান পুকুরে এআই ও ভার্টিক্যাল এক্সপানশন পদ্ধতির মাধ্যমে কীভাবে উৎপাদন বাড়ানোর যায় এবং লোকসানের হাত থেকে খামারিদের রক্ষা করা যায়, তা নিয়ে গবেষণায় ব্যাপক সাফল্য পেয়েছি।
এআই ব্যবহারে অল্প জমিতে অধিক মাছ চাষ করে অত্যাধিক লাভবান হওয়া যাবে এবং মাটি ও আবহাওয়ার জন্য টেকসই হবে। দ্রুত সময়ের মধ্যে ত্রিশালের ১২টি ইউনিয়ন ও একটি পৌর সভায় ১৩টি পুকুরে পাইলট প্রকল্প হিসেবে অল্প জমিতে অধিক মাছ চাষের কাজ শুরু হবে।
জুয়েল আহমেদ গত ২০২২সালে ত্রিশালের ইউএনও হিসেবে যোগদান করেন। প্রশাসনে সৎ ও নিষ্ঠাবান কর্মকর্তা হিসেবে তার সুনাম রয়েছে।